আল্লাহ্তায়ালার দর্শন
মুমিনগণ পরকালে বেহেশতে আল্লাহ্তায়ালার দীদার লাভ করবেন। এই দীদার বা দর্শন সম্পর্কে আমরা যেরকম ধারণা রাখি, সেরকম নয়। আল্লাহ্পাকের দীদারের ক্ষেত্রে দিক, প্রকার, উদাহরণ- কোনোকিছুই কল্পনা করা যায় না। দূরত্ব- নৈকট্যের ধারণাও সেখানে অচল। হাদিস শরীফে এসেছে,
তোমরা অতিশীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালককে এমনভাবে দেখবে, যেমন ভাবে দেখো চতুর্দশীর চাঁদকে।
এই হাদিসের বর্ণনায় বোঝা যায়, দীদারের সম্পর্ক কেবল দেখার সঙ্গে। নতুবা চাঁদ কখনো আল্লাহ্পাকের জাতের তুলনা হতে পারে না। রসুলেপাক স. এর উক্ত হাদিসের প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তার সঠিক অবস্থা আমাদের জ্ঞানের আওতাভূত যে নয়, একথাও বুঝতে হবে। দীদারের প্রতি ইমান রাখাই জরুরী। দীদারের রকম, প্রকার, অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ ( যা অসম্ভব ) করা জরুরী নয়। পৃথিবীতে জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহ্তায়ালার দীদার সম্ভব নয়। কেবল মেরাজের রাতে রসুলেপাক স. আল্লাহ্পাককে দেখেছেন। কিন্তু সেই দীদার হয়েছিলো ঊর্ধ্বজগতে। পৃথিবীতে নয়। হজরত শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন, মুহাদ্দিসীন, ফিকাহবিদ, দার্শনিকবৃন্দ, এমনকি তরিকার মাশায়েখগণ এ বিষয়ে একমত যে, আউলিয়াগণের কেউই স্বচক্ষে আল্লাহ্তায়ালাকে দেখতে পাননি। ‘কিতাবে তাআ’রুফ’ নামক গ্রন্থে লিখিত আছে, মাশায়েখ বা বুজর্গবৃন্দের কেউই স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখার দাবী করেননি। কেউ এ বিষয়ে কোনো দলিল-প্রমাণও দেননি। কিন্তু মূর্খ সুফীদের একদল (আদতে তারা সুফীদের কাতারভুক্তও নয়)আল্লাহকে দেখার দাবী করে থাকে। বুজর্গানে দ্বীন এ বিষয়ে একমত যে, স্বচক্ষে আল্লাহ্দর্শনের দাবীদার মিথ্যাবাদী এবং এরকম বাক্য মারেফত লাভ না হওয়ার চিহ্ন। আল্লাহ্পাককে স্বপ্নে দেখা সম্পর্কে অবশ্য মতভেদ পাওয়া যায়। কিন্তু একথা সত্য যে, স্বপ্নে আল্লাহর দীদার সম্ভব। পূর্ববর্তী বুজর্গগণ এ বিবরণটির প্রত্যয়ন করেছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহ্পাককে স্বপ্নে দেখে প্রশ্ন করলাম ‘হে আমার আল্লাহ! সর্বোত্তম ইবাদত কী এবং তোমার নৈকট্য অর্জনের নিকটতম উপায় কোনটি ? আল্লাহ্পাক জবাব দিলেন ‘কোরআনুল করীমের তেলাওয়াত’। ইমামে আজম র. বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একশত বার স্বপ্নে আল্লাহ্তায়ালাকে দেখেছেন। ইবনে সিরীন র. বলেন, স্বপ্নে আল্লাহ্পাককে দর্শনকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন ‘এরকম স্বপ্নদর্শন আসলে অন্তরের দর্শন। প্রকাশ্য চক্ষু তাঁকে দেখতে অক্ষম। যদি কেউ প্রকাশ্য চোখে আল্লাহকে দেখে, তবে সে দর্শন হবে মেছাল। আল্লাহ্ মেছ্লী নন। কিন্তু মেছালী।
মেছেল বলা হয় সম্পূর্ণ গুণাবলীর দিক দিয়ে যার সাথে তুলনা করা হয়, তার সমকক্ষ হওয়াকে। কিন্তু মেছালের মধ্যে গুণাবলীর সমতা আবশ্যকীয় নয়। যেমন আকল বা জ্ঞানকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়। অথচ জ্ঞানের সঙ্গে সূর্যেও সামগ্রিক সাদৃশ্য নেই। উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু এতোটুকু- সূর্যের আলোয় যেমন বস্তুসমুদয় স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়, জ্ঞানের আলোকেও তেমনি সুন্দর-অসুন্দর ভালোমন্দে র পার্থক্যরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেছাল হওয়ার জন্য এরকম ক্ষীণ কোনো সম্পর্ক থাকাই যথেষ্ট। এ কারণেই বাদশাহ্কে সূর্য এবং মন্ত্রীকে চন্দ্রের সঙ্গে উপমা দেয়া হয়। স্বপ্নে সূর্যদর্শনের ব্যাখ্যা এই যে- রাজদর্শন ঘটবে। আর চন্দ্রদর্শনের ব্যাখ্যা- ঘটবে মন্ত্রীদর্শন।
মেছালকে কোরআন মজীদে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে-
আল্লাহ্পাকের অতুলনীয় জাত বা সত্তা প্রদীপ, শিশা ও ফানুসের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। তিনি এসবের সাদৃশ্য থেকে পবিত্র ও মুক্ত। জয়তুন গাছের সঙ্গেও তিনি তুলনীয় নন। অবশ্যই নন। বরং এখানকার দৃষ্টান্ত— ওই ধরনের, যেমন কোরআন মজীদকে তুলনা করা হয়েছে ‘হাবলুম মানাতিনে’র (একটি আলোকরশ্মির) সঙ্গে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি রশ্মি কোরআনের সামগ্রিক সাদৃশ্য নয় । ফেরেশতাবৃন্দ এবং রমণীকুলও আখেরাতে আল্লাহ্পাকের দীদার লাভ করবেন। তবে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে মুমিনদের মতোই সংখ্যাগত এবং অবস্থাগত পার্থক্য তো থাকবেই। জ্বিন স¤প্রদায় আল্লাহ্তায়ালার দীদার পাবে না। এ সম্পর্কে শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন ‘জ্বিনদের আল্লাহ্দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার কথাটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কেননা, ইমামে আজম আবু হানিফা র. এবং অন্যান্য ইমামগণের এক দল এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, জ্বিনেরা তাদেও নেক আমলের সওয়াব পাবে না। বেহেশতেও তারা প্রবেশ করতে পারবে না। তাদের সৎ কাজের প্রতিদান হবে এই যে, তারা দোজখের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাবে। তিনি আরো বলেন ‘কাফের এবং মুনাফিকেরাও কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহকে কঠোর এবং প্রচন্ড রোষাম্বিত অবস্থায় দেখবে। এরপর চিরদিনের জন্য সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে তাদের আক্ষেপ এবং আজাব ক্রমাগত প্রচন্ডতর হতে থাকে’।[1]আল্লাহর নূরের উপমা ওই নূরের মতো, যার মধ্যে থাকে প্রদীপ এবং প্রদীপটি শিশার ফানুসের মধ্যে আলো বিকিরণ করতে থাকে।
— সূরা নূর
তথ্যসূত্র
- ↑ ইসলামী বিশ্বাস (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)